রসুল (সা.)-এর মর্যাদা অতুলনীয়
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী |
মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০২৩ |
পড়া হয়েছে 292 বার
মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
অন্যান্য দিনের মতো আজকের দিনটিও বেশ কর্মব্যস্ততায় কাটছে তার। জগৎ আলোকিত করার সুমহান দায়িত্ব কাঁধে যাঁর তাঁর দিন ও রাত তো ব্যস্ততায় কাটবেই। দিনে মানুষের সঙ্গে আর রাতে মাবুদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রধান কাজ। বলছিলাম আখেরি নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা। ব্যস্ততার মাঝেই এমন এক আনন্দ সংবাদ পেলেন যে, তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। আনন্দের ঢেউয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। সাহাবিদের ডেকে বললেন, তোমরা কে কোথায় আছ, এসো! আমাকে অভিনন্দন জানাও। আমার ওপর আজ এক নয়নজুড়ানো আয়াত নাজিল হয়েছে। আয়াতটি হলো, ‘ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান নাবিয়্যি। ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু সাল্লু আলাইহি ওয়াসাল্লিমা তাসলিমা। অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর সালাত পাঠায়। হে বিশ্বাসীরা! তোমরাও তাঁকে সালাত পাঠাও এবং যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে সালাম পাঠাও।’ (সুরা আহজাব-৫৬)তাফসিরে রুহুল বয়ানের লেখক বলেন, এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর রসুল (সা.) এত খুশি হয়েছেন যে, তিনি বলেন, ‘দুনিয়া ও দুনিয়ার বুকে যত দামি সম্পদ আছে, আমার কাছে এ আয়াতের তুলনায় সবকিছু অতি তুচ্ছ।’ বিখ্যাত আলেম হাফেজুল হাদিস ইমাম সাখাভি (রহ.) বলেন, ‘এ আয়াত নাজিলের একটাই উদ্দেশ্য- দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দেওয়া নবীজি (সা.)-এর শান ও মান অতুলনীয়। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের মজলিসে হুজুরের জন্য সালাত আসর বসান, সেখানে নবীজির গুণকীর্তন করেন, নিজের মহব্বতের কথা বলেন। তাই বিশ্বাসীদের অবশ্যই কর্তব্য নিজ নিজ জায়গা থেকে হুজুরের জন্য সালাত ও সালাম পাঠানো।’ আল্লামা খতিব শামসুদ্দিন (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা কীভাবে তাঁর হাবিবের ওপর সালাত পাঠান এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ইবনে আব্বাসের তাফসিরে। তিনি বলেন, আল্লাহর সালাত মানে হলো খাস রহমত। আর ফেরেশতাদের সালাত হলো সে রহমত যেন অঝোর বর্ষণ হতে থাকে তার জন্য দোয়া করা। আমাদের সালাতও অনেকটা ফেরেশতাদের মতোই। তাই দরুদ শরিফের শুরুতেই বলি, আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা মুহাম্মাদ! হে আল্লাহ! আপনার হাবিবের ওপর আপনি সালাত পাঠান অর্থাৎ অঝোর ধারায় রহমত বর্ষণ করতে থাকুন।’মুফাসসির আবুল আলিয়া (রহ.) বলেন, আল্লাহর সালাতের দুটো অর্থ। একটা হলো, আল্লাহ তাঁর হাবিবের ওপর রহমত বর্ষণ করেন। দ্বিতীয়টি হলো, তিনি ফেরেশতাদের মজলিসে রসুলের শান-মান তুলে ধরেন। আর ফেরেশতাদের সালাতের অর্থ হলো সব সময় নবীজির জন্য দোয়া করা। এই যদি হয় আল্লাহতায়ালা ও ফেরেশতাদের আমল, তাহলে যারা দুনিয়ায় আছে তাদের তো সুযোগ পেলেই নবীজির উদ্দেশে সালাত ও সালাম পাঠানো নৈতিক দায়িত্ব হয়ে যায়। আয়াতে আল্লাহতায়ালা যথার্থভাবে সালাম পাঠাতে বলে একটা সূক্ষ্ম বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। শুধু মুখে ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া আইয়্যুহান্নাবিয়্যু’ বললেই সালামের পুরোপুরি হক আদায় হবে না, বরং কথা-কাজ-আচরণ সবকিছুতে নবীজির প্রতি প্রেম-ভক্তি ও সুন্নাহর অনুসরণ ফুটিয়ে উঠতে হবে। তা হলেই আয়াতে বলা ‘যথার্থ’ শব্দের সঠিক বাস্তবায়ন হবে। আরবি ব্যাকরণের দিক থেকে ব্যাখ্যা করলে আয়াতের তাৎপর্য আরও সহজে বোঝা যাবে। আয়াতটি শুরু হয়েছে ‘হরফে ইন্না’ দিয়ে। ইন্না অর্থ নিশ্চয়। কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আরবিতে ইন্না ব্যবহার হয়। শুরুতে ইন্না শব্দ দিয়ে গুরুত্ব দেওয়ার পর শেষে আবার মাসদার (তাসলিমা) ব্যবহার করে আরও জোরদার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ বোঝাতে চাইছেন, সালাত ও সালাম দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটা থেকে কোনোটা কম গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। সালামের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য মাসদার ব্যবহার করা হয়েছে, আর সালাতের গুরুত্বের জন্য হরফে তাকিদ ইন্না ব্যবহার করা হয়েছে।
তাফসিরে দুররে মানসুরসহ একাধিক তাফসিরে এসেছে, হজরত আবদুর রহমান ইবনে আবু লাইলা (রহ.) বর্ণনা করেন, কাব ইবনে উজরা (রা.) আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, আমি কি আপনাকে এমন একটি হাদিয়া (উপহার) দেব না; যা আমি নবীজি (সা.) থেকে শুনেছি? জবাবে আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি আমাকে সেই হাদিয়া দিন। তিনি বললেন, একদিন আমরা রসুলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রসুল! আপনাদের ওপর অর্থাৎ আহলে বাইতের ওপর কীভাবে দরুদ পাঠ করতে হবে? জবাবে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা এভাবে বলো ‘আল্লাহুম্মা সল্লিআলা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলী মুহাম্মাদ- কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলী ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুন মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদ ওয়ালা আলী মুহাম্মাদ কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়ালা আলী ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুন মাজিদ। অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদের ওপর এবং মুহাম্মাদের বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেভাবে আপনি ইবরাহিমের এবং ইবরাহিমের বংশধরদের ওপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি অতি প্রশংসিত, অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ ও মুহাম্মদের পরিবার এবং পরিজনের ওপর বরকত করুন। যেভাবে বরকত নাজিল করেছেন ইবরাহিম ও তাঁর পরিবার-পরিজনের ওপর। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত ও মহান।’
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি; পীর সাহেব, আউলিয়ানগর
লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন…
মন্তব্য...
comments