লোভের আগুন কেড়ে নেয় জীবনের ফাগুন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী | মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর ২০২২ | পড়া হয়েছে 53 বার

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

 

সেদিন এক মুক্তমনা বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, হুজুর!  কোরআনের অনেক কিছু কাটছাঁট করার সময় এসে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়েও আমাদের সেকেলে গ্রন্থটি হুবহু আওড়ানোর কি প্রয়োজন আছে? মনে মনে বললাম, আল্লাহ কারও থেকে ইমানের নুর ছিনিয়ে নিয়ে গেলেই তার পক্ষে কোরআন তেলাওয়াতকে ‘আওড়ানো’ মনে হতে পারে। বললাম, একটু কি উদাহরণ দিয়ে বলা যায় কোরআনের কোন অংশ আধুনিক যুগে অচল হয়ে পড়েছে? চেহারায় পান্ডিত্যভাব ফুটিয়ে বন্ধুটি বললেন, এই যে সুরা লাহাবের কথাই ধরুন না। এখনো কি আমাদের আবু লাহাবের জীবনী পড়ার কোনো প্রয়োজন আছে? আপত্তি শুনেই বুঝলাম কোরআন সম্পর্কে বন্ধুটির জ্ঞান প্রায় শূন্য। নয়তো সুরা লাহাবকে আবু লাহাবের জীবনী বলে দাবি করতেন না। কমনসেন্স অনুযায়ী ৫ আয়াতের একটি ছোট্ট সুরায় একজন মানুষের জীবনী বলা কীভাবে সম্ভব? আর আবু লাহাবের জীবনী আল্লাহ বলবেনই বা কেন? বলেছেন আবু লাহাবের চরিত্র সম্পর্কে। যদি আল্লাহ আবু লাহাবের জীবনী বর্ণনা করতেন তাহলে হয়তো প্রশ্ন উঠত- এই ব্যক্তির জীবনী আমাদের কী কাজে লাগবে? যেহেতু আল্লাহতায়ালা আবু লাহাবের চরিত্র বর্ণনা করেছেন তাই এ সুরা মানব জাতির জন্য নিত্য তেলাওয়াতযোগ্য একটি সুরা এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা হলো যৌক্তিক উত্তর। আর শরিয়তের দাবি হলো কোরআনের কোনো আয়াত বা সুরা বুঝে না এলেও তেলাওয়াত করতে হবে, মানার চেষ্টা করতে হবে, এ নিয়ে কোনো বেআদবিপূর্ণ মন্তব্য করা যাবে না। বন্ধুকে বললাম, আসলে আবু লাহাবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ যুগে যুগে পৃথিবীতে আসতে থাকবে। তাদের হেদায়াতের জন্যই আল্লাহ কোরআনে আবু লাহাবের চরিত্র সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। সুরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাব। অর্থাৎ, আবু লাহাবের দুই হাতই নষ্ট হয়ে গেছে। দুই হাত বলতে আল্লাহ কী বুঝিয়েছেন এ নিয়ে মুফাসসিরদের মধ্যে অনেক মত রয়েছে। একদল মুফাসসির বলেছেন, দুই হাত মানে হলো দুনিয়া ও আখেরাত। আরেকদল মুফাসসিরের মতে, দুই হাত বলতে শক্তিসামর্থ্য বোঝানো হয়েছে। সুফিদের একদল বলেন, যদিও নবীজির চাচা আবু লাহাবকে উদ্দেশ করে এ সুরা নাজিল হয়েছে কিন্তু আবু লাহাবের বৈশিষ্ট্যধারী প্রতিটি মানুষই এ সুরার আলোচ্য ব্যক্তি। আবু লাহাব শব্দের অর্থ অগ্নিশিখার পিতা। মানুষ কখন আগুনের বাবা হয়ে যায়? আগুন হলো লোভের প্রতীক। আগুন যেমন সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়েও ক্ষান্ত হয় না বরং আরও তীব্রভাবে জ্বলতে থাকে তেমনি লোভী মানুষের মন সবকিছু পাওয়ার পরও লোভ কমে না, বরং আগুনের মতো লেলিহান শিখা ছড়িয়ে বাড়তে থাকে। সুতরাং প্রত্যেক লোভী ব্যক্তিই হাকিকতে আবু লাহাব বা আগুনের পিতা। আর যে আবু লাহাব বা লোভের আগুনে সর্বক্ষণ জ্বলতে থাকে তার দুই হাত কাটা থাকে। দুই হাত মানে হলো আধ্যাত্মিক শক্তি তার নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো কোনো মুফাসসির বলেছেন, দুই হাত বলতে তার জীবনের সব চেষ্টা-প্রচেষ্টাকে বোঝানো হয়েছে।

দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেন, মাআগনা আনহু মালুহু ওয়ামা কাসাব। দুই হাত কাটা আবু লাহাবের সম্পদ ও উপার্জন কোনো কাজেই আসে না। এ আয়াত বলে বন্ধুটির দিকে তাকালাম। বললাম বন্ধু! এই যে অনেকের সন্তান-সন্ততি পাশে নেই, স্ত্রীও ছেড়ে পরপুরুষের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে, সে-ও আরেকজনের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে, এ জীবনই কি সে চেয়েছিল? তোমার উপার্জন ও সম্পদ আজ কোনো কাজেই এলো না। জীবনে অর্থ ছাড়া কিছুই বোঝো না। শুধু অর্থই আছে আর কিছুই নেই তোমার। আজ যদি মরে যাও কে তোমাকে দাফন করবে? কে তোমাকে গোসল করাবে? কোথায় তোমার কবর হবে? কে তোমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সওয়াব রেসানি করবে? তোমার স্বজন বলতে তো কেউ এখন তোমার পাশে নেই। তুমি কি জানো আবু লাহাবেরও একই অবস্থা হয়েছিল? সে যখন মারা গিয়েছিল সন্তান-সন্ততি কেউ তার লাশ দাফন পর্যন্ত করেনি। লাশ থেকে এত পচা দুর্গন্ধ আসছিল যে, সন্তানরা টাকা দিয়ে লোক ঠিক করেছে লাশটি যেন কোনো গর্তে ফেলে আসে। লোকেরা দুর্গন্ধে লাশের কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। অনেক চেষ্টার পর বড় লাঠি দিয়ে লাশটি ঠেলতে ঠেলতে নগরীর বাইরে এক গর্তে ফেলে আসা হয়েছে। কথাগুলো শুনে বন্ধুর মুখটি কেমন বেজার হয়ে গেল। সে বলল, পরের আয়াতে কী আছে শোনাও। আমি বললাম, এমন ব্যক্তি অচিরেই যন্ত্রণাদায়ক জীবনের অধ্যায়ে যাত্রা করবে। দেখো, যে ব্যক্তির লোভ কখনই শেষ হয় না সে তো মানসিক যন্ত্রণার শাস্তি পাবেই। আর মৃত্যুর পর কবরের আজাব তো আছে। এতটুকু শোনার পরই বন্ধু বলল, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে, সুরা লাহাব আমাদের প্রত্যেকের পড়া উচিত। অর্থলোভ আমাদের ভিতর এমনভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে যে ভালোমন্দ কোনো কিছুর বিচার না করেই আমরা দুই হাতে অবৈধ অর্থ কামাই। আরও চাই আরও চাই। তারপর যাদের জন্য জীবন-যৌবন শেষ করে হারাম পথে অর্থ কামালাম তারাই আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আর এভাবেই আমাদের দুই হাত ভেঙে যায় এবং আমরা যন্ত্রণাদায়ক জীবনের অধ্যায়ে পা রাখি। বন্ধুটির উপলব্ধি দেখে মনটা ভরে উঠল।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

  www.selimazadi.com

লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন…

মন্তব্য...

comments

কে. আর প্লাজা (১২ তলা) ৩১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
ফোন: ০২-৯৫১৫৬৪৬, মোবাইল: ০১৭১৮৭৭৮২৩৮, ০১৯৬৫৬১৮৯৪৭
ইমেইল- mawlanaselimhossainazadi1985@gmail.com
ওয়ের সাইট: selimazadi.com