সায়েমকে পথ দেখায় বদরের বিজয় মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী | মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০১৭ | পড়া হয়েছে 543 বার

আজ ১৭ রমজান। দ্বিতীয় হিজরির এদিন সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের প্রথম ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ।

আল্লাহ সেদিন তার রসুল (সা.) ও মোমিনদের বিজয়ী এবং কাফের ও মুশরিকদের পরাজিত করার মাধ্যমে হক ও বাতিলের পার্থক্য করে দিয়েছেন। কোরআনে আল্লাহ দিবসটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণের দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট  ছিল, রসুলুল্লাহ (সা.) সংবাদ পান যে, আবু সুফিয়ান কোরাইশ কাফেরদের একটি বাণিজ্য দল নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছেন। তিনি সাহাবিদের নির্দেশ দেন কোরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার গতিরোধে বের হতে। কেননা কোরাইশরা রসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কাফের  কোরাইশরা মুসলিমদের তাদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ থেকে বের করে দিয়েছিল; অবস্থান নিয়েছিল ইসলামের দাওয়াতের বিরুদ্ধে। রসুলুল্লাহ (সা). ৩১০-এর বেশি কিছু সাহাবিকে নিয়ে বদর প্রান্তরে রওনা হন। তাদের ছিল কেবল দুটি ঘোড়া ও ৭০টি উট, যাতে তারা পালাক্রমে চড়ছিলেন। এ যুদ্ধে ৭০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। তারা বাণিজ্য কাফেলা ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চাননি। কিন্তু আল্লাহতায়ালা অনির্ধারিত সময়ে তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ও শত্রুদের মাঝে মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আবু সুফিয়ান মুসলিমদের অবস্থা জানতে পেরে কোরাইশদের কাছে এই মর্মে একজন চিৎকারকারী সংবাদবাহক পাঠায়, যেন কোরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই আবু সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমুদ্র উপকূল ধরে রওনা দিল এবং নিরাপদে পৌঁছে গেল। কিন্তু কোরাইশ সম্প্রদায় তাদের কাছে চিৎকারকারীর মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছামাত্রই তাদের নেতৃস্থানীয় এক হাজার লোক সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশে রওনা দিল। তাদের ছিল ১০০টি অর্শ্ব ও ৭০০ উট। আল্লাহর ভাষায় তারা বের হয়েছিল, ‘অহংকার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহর রাস্তাকে মোকাবিলা করতে। ’ (সুরা আনফাল : ৪৭)। রসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সৈন্যদল সাহাবিদের সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং বদর কূপগুলোর কাছের পানির কূপের কাছে যাত্রাবিরতি দিলেন। মুসলিমরা যুদ্ধের মাঠে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য উঁচু স্থানে একটি তাঁবু বানালেন, যেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান দেখা যায়। তিনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারপর রসুলুল্লাহ (সা.) সেখান থেকে নামলেন, সাহাবিদের কাতার সুন্দর করে সাজালেন, যুদ্ধের ময়দানে চলতে থাকলেন এবং মুশরিকদের পতনের স্থল ও হত্যার স্থানগুলোর দিকে ইঙ্গিত করতে থাকলেন। আর তিনি বলছিলেন, ‘আল্লাহ চাহে তো এটা অমুকের পতিত হওয়ার জায়গা, এটা অমুকের মৃত্যুস্থান। ’ পরে দেখা গেল, রসুলের ইঙ্গিতের জায়গা থেকে ওই লোকদের মৃত্যু সামান্যও হেরফের হয়নি। (মুসলিম : ১৭৭৯)। অতঃপর দুটি দল (মুসলিম ও মুশরিক) পরস্পর মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ চলতে থাকল এবং প্রচণ্ড রূপ লাভ করল। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁবুতে অবস্থান করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা.) ও সাদ ইবনে মুআজ (রা.)। তারা দুজনই রসুলুল্লাহ (সা.) কে পাহারা দিচ্ছিলেন। এরপর রসুলুল্লাহ (সা.) রবের কাছে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কাতর প্রার্থনা জানালেন; সাহায্য ও বিজয়ের প্রার্থনা করলেন; উদ্ধার চাইলেন। তারপর রসুল সামান্যতম সময়ের জন্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। তারপর এ অবস্থা থেকে বের হয়ে বললেন, ‘অবশ্যই কাফেররা পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠদেশ দেখিয়ে পলায়ন করবে। ’ (সুরা কামার : ৪৫)। তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘ওই সত্তার শপথ যার হাতে মোহাম্মদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, ধৈর্য ধারণ করে সওয়াবের আশায় সামনে অগ্রসর হয়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন না করে যুদ্ধ করে মারা যাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। ’ (মুসলিম : ১৯০১)। রসুলুল্লাহ (সা.) এক মুষ্টি মাটি বা বালি নিয়ে কাফের দলের প্রতি ছুড়ে মারলেন। রসুলের নিক্ষিপ্ত বালি তাদের সবার চোখে বিদ্ধ হলো। তাদের সবার চোখেই তা বিদ্ধ হলো, তারা তাদের চোখের মাটি ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যা ছিল আল্লাহর নিদর্শনগুলোর একটি নিদর্শন। ফলে মুশরিক সৈন্যদের পরাজয় হলো এবং তারা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পালিয়ে গেল। আর মুসলিমরা তাদের পিছু নিয়ে তাদের হত্যা ও বন্দী করে ফেলল। এভাবে তাদের ৭০ জন কাফের নিহত ও ৭০ জন বন্দী হলো। নিহতের মধ্যে ২৪ জন কাফের   কোরাইশ নেতাদের বদরের একটি কূপে ছুড়ে ফেলা। এদের মধ্যে ছিল আবু জাহল, শায়বা ইবনে রবিআ ও তার ভাই উতবা এবং তার ছেলে অলিদ ইবনে উতবা। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিয়ম ছিল, তিনি কারও ওপর বিজয়ী হলে সেখানে তিন দিন অবস্থান করতেন। সে অনুসারে বদরের তৃতীয় দিনে তিনি তার বাহন প্রস্তুতের নির্দেশ দিলেন এবং চলতে লাগলেন। সাহাবিরা তার পিছু নিলেন। অবশেষে তিনি কূপের পাশে এসে দাঁড়ালেন। প্রত্যেকের নাম ও বাবার নাম ধরে ডাকলেন এবং বলতে লাগলেন, হে অমুকের পুত্র অমুক, হে অমুকের পুত্র অমুক, আজ তোমাদের জন্য কি এটা আন্দদায়ক হতো না, যদি তোমরা আল্লাহ ও তার রসুলের আনুগত্য করতে? আমাদের রব আমাদের বিজয় দান করার ব্যাপারে যে ওয়াদা করেছিলেন, তা আমরা যথার্থ পেয়েছি। তোমরা কি তোমাদের রবের ওয়াদা পেয়েছ? (বোখারি : ৩৯৭৬)। এ হচ্ছে বদর যুদ্ধ। যে যুদ্ধে অল্পসংখ্যক সৈন্য বাহিনী বেশিসংখ্যক সৈন্য বাহিনীর ওপর বিজয় অর্জন করেছিল। ‘একটি দল লড়াই করছিল আল্লাহর পথে এবং অন্য দলটি দিল কাফের। (সুরা আলে ইমরান : ১৩)। অল্পসংখ্যক লোকের দলটি বিজয় অর্জন করেছিল। কেননা তারা আল্লাহর দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা আল্লাহর দীনের কলেমা বুলন্দ করার জন্য ও আল্লাহর দীনের পক্ষে প্রতিরোধ করার জন্য যুদ্ধ করেছিল। ফলে মহান আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেছিলেন। অতএব রমজান শুধু সিয়াম সাধনার মাস নয়, এটি ইমানের বিজয়ের মাসও। তাই প্রত্যেক ইমানদারের উচিত রমজানে ইমানের বিজয়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া। লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব , www.selimazadi.com

এই লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছিল। দেখতে হলে ক্লিক করুন…

মন্তব্য...

comments

কে. আর প্লাজা (১২ তলা) ৩১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
ফোন: ০২-৯৫১৫৬৪৬, মোবাইল: ০১৭১৮৭৭৮২৩৮, ০১৯৬৫৬১৮৯৪৭
ইমেইল- mawlanaselimhossainazadi1985@gmail.com
ওয়ের সাইট: selimazadi.com